টেকনাফ-উখিয়া আসনের বর্তমান এমপি শাহীন চৌধুরী। তাঁর স্বামী এ আসনের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। এই আসনে এবারও স্বামী-স্ত্রী দু’জনই নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীকে হারিয়ে এবারও মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন স্ত্রী। অবশ্য স্ত্রী এমপি হলেও খুব একটা ক্ষতি নেই বদির। আসল এমপিকে অন্তরালে রেখে পুরো টেকনাফ দাপিয়ে বেড়ান বদি।
গত পাঁচ বছর তাঁর স্ত্রী শাহীন এমপি থাকলেও মাঠেঘাটে ও প্রশাসনে সরব ছিলেন তাঁর স্বামী। চলছেন রাজার হালে, পাচ্ছেন এমপির প্রটোকলও। সরকারি বরাদ্দও বণ্টন করছেন তিনি। কে কোথায় কী কাজ পাবে, কোন ইউনিয়নে কী কাজ হবে– তার সবই তদারকি করেছেন বদি। এ কারণে এলাকায় তিনি ‘নকল এমপি’ উপাধি পেয়েছেন।
এমপি থাকাকালে মাত্র পাঁচ বছরে ১৯ গুণ সম্পদ বাড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন বদি। তাঁকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা থাকার পরও ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি পদে নৌকার মনোনয়ন পেতে তার অসুবিধা হয়নি। পেয়েছেন বিজয়ও। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের টিকিট পাননি তিনি।
পাঁচ কারণে এবারও বদিকে বাদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মাদক পাচারের তালিকায় বদির ভাই, বোন, মামা, ভাগনেসহ ২৬ স্বজনের নাম রয়েছে। মানব পাচার ও রোহিঙ্গাদের বৈধকরণের তালিকায়ও আছে তাঁর নাম। অল্প সময়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তিনি। দুর্নীতি মামলায় এর আগে তিন বছরের সাজা হয়েছে তাঁর। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোন্দলও বাদ পড়ার একটি কারণ।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর এলাকায় মানব পাচারের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে বছরে মাদকের বেচাকেনা হয় ৩ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকই দখল করে রেখেছে টেকনাফের ইয়াবা। সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধির প্রশ্রয় থাকায় অবৈধ এ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
বদি এমপি থাকাকালে মানব ও মাদক পাচার এবং রোহিঙ্গা বৈধকরণের তালিকার তিনটিতেই ছিল তাঁর ও স্বজনদের নাম। তখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকায়ও তৎকালীন এমপি বদিকে মূল পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। ওই তালিকায় তাঁর ১৭ জন আত্মীয়ের নাম ছিল। আবার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহায়তাকারীদের তালিকায়ও তিনি ছিলেন ১ নম্বরে।
শাহীন চৌধুরী এমপি হওয়ার পরও পাল্টায়নি এই চিত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোষ স্বীকার করে ১০১ ইয়াবা কারবারি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে প্রশাসনের কাছে। তাদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। রায়ে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ১০১ জনের মধ্যে রয়েছেন বদির আট ভাই। তাদের সবাই এখন কোটিপতি। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব গাড়ি আর বহুতল বাড়ি। বদি ও তাঁর স্ত্রী এমপি হওয়ার পরেই ঘুরেছে তাদের ভাগ্যের চাকা।
এবার নৌকা পেতে গত পাঁচ বছরে টেকনাফ-উখিয়ায় ছায়া এমপি হয়ে ছিলেন তিনি। টিআর, কাবিখা থেকে শুরু করে সরকারি সব বরাদ্দ বণ্টনও করতেন তিনি। ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’র সময় টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। তখনও এলাকায় সব কাজ তদারকি করেছেন বদি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে সরকারি বরাদ্দও বণ্টন করেছেন তিনি।
২০০৮ সালে ৮ লাখ টাকা ধার নিয়ে কক্সবাজার-৪ আসনে প্রথম নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন বদি। এর পাঁচ বছর পর আমূল বদলে যায় তাঁর অর্থবিত্ত। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া পরের হলফনামা বলছে, মাত্র পাঁচ বছরে বদির নিট সম্পদ বেড়েছে ১৯ গুণেরও বেশি।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বদিকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে সমকালকে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের অনুসারীরা তাঁকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই মানব ও মাদক পাচারের বিভিন্ন তালিকায় যুক্ত করছে। এলাকায় তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়।
আসল এমপিকে দূরে রেখে এলাকা দাপিয়ে বেড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমার স্ত্রী এমপি হলেও মহিলা মানুষ। সব সময় সব জায়গায় যেতে পারেন না। তার এই শূন্যতা পূরণ করতে মাঠেঘাটে থাকি আমি। এটার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।’
তার এই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর বলেন, ‘এমপি না হয়েও বদি কীভাবে সরকারি প্রটোকলে সুবিধা পান তা বোধগম্য নয়। বদি ও তাঁর স্ত্রীর কারণে মানব ও মাদক পাচারের একটি স্থায়ী বদনামের ভাগীদার হয়েছে টেকনাফবাসী। তার পরও ঘুরেফিরে মনোনয়ন পাচ্ছেন তারা। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সুত্র: সমকাল
পাঠকের মতামত